সন্ধ্যে নামার ঠিক আগের মুহূর্তে, শহরের সব আলো যেমন নিঃশব্দে জ্বলে ওঠে, তেমনি একটা আলো প্রতিদিন মৈত্রেয়ীর চোখে জ্বলে। সে আলো পোড়ায় না, কাঁদায়ও না, কেবল মনটাকে একটা নরম মেঘের মতো মুড়ে রাখে।
সে তখন শহরের একটা ক্যাফেতে বসে, টেবিলে রাখা কফির কাপটা থেকে ধোঁয়া উঠছে, জানালার বাইরে আকাশটা কমলা থেকে ধূসর হয়ে যাচ্ছে। একসময় সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা একটা মুখ মনে পড়ে — রুদ্র।
রুদ্র, সেই ছেলেটা, যার চোখে ছিল চুপচাপ একটা নদীর মতো গভীরতা। ক্লাসে সে সবার থেকে আলাদা ছিল। কারও সঙ্গে বেশি মেশার চেষ্টা করত না, না কোনো দোষ খুঁজত। সে যেন সবকিছু মেনে নিত, শুধু আকাশ ছাড়া। ক্লাস চলাকালীনও জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকত, এমনভাবে, যেন ওর কোনো অপেক্ষা আছে—অতল, ব্যক্তিগত।
মৈত্রেয়ীর তখন একটু রাগ হতো। “এই ছেলেটা কি নিজেকে পৃথিবীর বাইরে ভাবে?” ভাবত সে।
একদিন সহ্য করতে না পেরে বলে ফেলেছিল,
“তুমি এত চুপচাপ কেন? কিছুই ভালো লাগে না তোমার?”
রুদ্র তাকিয়ে বলেছিল,
“ভালো লাগে বলেই তো কথা কম বলি। অনেক কিছু হারিয়ে যায় কথা বললে, যেমন- আকাশের রং। তুমি লক্ষ্য করেছো, বিকেলটা কখনও ঠিক একইরকম হয় না?”
মৈত্রেয়ী তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। খুব সাধারণ কথা, অথচ মনে গেঁথে গিয়েছিল অদ্ভুতভাবে। সে প্রথমবার বুঝতে পেরেছিল, রুদ্র হয়তো অন্যরকম। না, অদ্ভুত না—সুন্দর। নিঃশব্দভাবে।
তারপর সময় কেটেছে। কলেজের শেষ দিন। সবাই ব্যস্ত ছবি তোলায়, চিৎকারে, বন্ধুদের সঙ্গে শেষ মুহূর্তটা মুঠোয় ধরে রাখতে। আর রুদ্র? এক কোণায় দাঁড়িয়ে, চোখে তার সেই চিরচেনা নীরবতা।
মৈত্রেয়ী কাছে গিয়ে বলেছিল —
“তুমি একটাও ছবি তুললে না?”
রুদ্র হেসে বলেছিল,
“আমার দরকার নেই। আমি তো মনে রেখে দেব।”
তখনই মেয়েটা একরাশ ভালোবাসা আর বিস্ময়ে বলেছিল,
“তুমি একটু অদ্ভুত, জানো?”
আর রুদ্র আস্তে করে মাথা নীচু করে বলেছিল—
“তোমার জন্যে রোদ হাতে রাখতে চেয়েছিলাম, তা হয়তো পারিনি।”
মৈত্রেয়ী সেই কথাটার মানে খুঁজে ওঠার আগেই, ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল রুদ্র। তারপর আর কোনো খোঁজ ছিল না। না ফোন, না বার্তা। সময়ের স্রোত তাদের দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আলাদা আলাদা দিকে।
পাঁচ বছর পর…
এক বিকেলে, পুরানো আলমারি ঘাঁটতে গিয়ে মৈত্রেয়ীর হাতে পরে একটা পুরানো ডায়েরি। হলদেটে পাতায় লেখা সেই পরিচিত হাতের লেখা—রুদ্র।
“তুমি যদি কখনো জানো, আমি কীভাবে তোমার প্রতিটা সন্ধ্যে ধরে রাখতে চেয়েছিলাম, তাহলে বুঝবে — ভালোবাসা মানে সবসময় পাশে থাকা নয়, অনেক সময় তা শুধু হয়ে থাকা… নীরবে, আলো হয়ে। তোমার ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিলাম যতবার, সেই ছায়ার নীচেই আমি আমার ভুবন খুঁজেছি। হয়তো তুমি কোনোদিন জানবে না। তবু, যদি জানো… এই চিঠিটা রোদ হয়ে থাকবে তোমার জানালার পাশে।”
মৈত্রেয়ীর চোখ ভিজে আসে। ডায়েরির পাতাগুলো ওর আঙুল ছুঁয়ে কেঁপে ওঠে, যেন কোনো হারিয়ে যাওয়া স্পর্শ ফিরেছে জীবনে।
সে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায়। আকাশটা আবার কমলা। যেন রুদ্রর চোখের ভাষা ফিরে এসেছে সেই শেষ বিকেলে।
তখন আস্তে করে সে বলে ওঠে—
“হয়তো তুমিই সেই রোদ, আমি আজও হাতে রাখি… প্রতিদিন। কথা হয়নি, ছবি হয়নি, তবু মনে থেকে গেছো… ঠিক যেন চুপচাপ রোদ — মনের জানালায় বসে থাকা।
শেষ নয়, হয়তো ভালোবাসার আসল গল্প শুরুই হয়, যখন কোনো চিঠি আর লেখা হয় না… তবু মন প্রতিদিন চলে যায় সেই হারিয়ে যাওয়া পাতায়।
শুধু একটি কথা থেকে যায়—
“তুমি আমার নীরব অভ্যেস।”
-written by ©thesudipbiswas
0 Comments
Please do not enter any spam link in the comment box