একই পথে চলতে চলতে আমাদের অনেকের সাথে একটা পরিচয় হয়ে যায়। ক্ষণিকের দেখা বা আলাপ মনে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরী করে দিয়ে যায়।
বুবু তখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে, তাদেরই গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রতিদিন তার বাবা নিখিলবাবু অফিস যাওয়ার সময় তাকে বিদ্যালয়ে ছেড়ে দিয়ে যান এবং তার দাদু পরিমলবাবু ছুটি হলে বাড়িতে নিয়ে আসেন। দাদু-নাতনির জুটিটি দর্শনীয় আর নাতনির যতও আবদার সব যেন এই দাদুর কাছে।কোন কিছু তেই দাদুর মানা নেই, সুতরাং বুবুর ইচ্ছার পুটুলি তার এই দাদু।
সময়টা ছিল গ্রীষ্মের, মাঝে মাঝে কালবৈশাখীর জন্য একটু ঝড় ও বৃষ্টি হচ্ছে। গরমের ছুটি পরতে আর কয়েক দিন বাকি, সকালে ভালো রোদ ঝলমল করছিল। বাবা নিখিলবাবু সকালে তার কন্যা সন্তান টিকে বিদ্যালয়ে ছেড়ে দিয়ে অফিস চলে গিয়েছেন। ছুটির ঠিক আগে আগে হটাৎ মেঘ ঘন করে আসলো, চারিদিকে সব যেন অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। আবহাওয়া এত খারাপ হয়ে গেলো যে দাদু পরিমলবাবু বাড়ি থেকে বের হতে পারছেন না। সময় গড়িয়ে যায়, ছোট্ট বুবু বিদ্যালয়ে কী করছে, বাড়ির সকলে তা নিয়ে অলীককল্পনা শুরু করে দিয়েছে।
সেই সময় টেলিফোনের বিষয়টা এতটা ছিল না, ফলতঃ বলা ছিল বাড়ি থেকে কেও না গেলে, বুবু যেন বিদ্যালয় থেকে না বের হয়। বুবু এটা ভাল করেই জানতো বারণ করার কারণ কী ছিল।
দুর্যোগ কমলে দাদু বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখলেন, তার প্রিয় নাতনী বিদ্যালয়ে নেই। দুশ্চিতায় দানা বাঁধতে লাগল। ছোট্ট মেয়েটি তাহলে গেলো কোথায়। গ্রামের বিদ্যালয়, চারপাশ খোলা। তবে কি কোন বিপদ হল।
ঝড় বৃষ্টিতে সব অগোছলো, বিদ্যালয়ে কাকে জিজ্ঞাসা করবেন এই ভেবে পরিমল বাবু এদিক-ওদিক করছেন। হটাৎ বুবুর একজন সহপাঠী বন্ধুর কাছে থেকে জানা গেলো যে একজন বয়স্ক লোক একটা রিক্সা করে বুবু কে নিয়ে গেছে বাড়ির দিকে।
কে এই বয়স্ক লোক, সত্যি সত্যি কোনো বিপদ হলো না তো। পরিমল বাবু হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন বাড়ির দিকে, জীবনটা হয়তো বেরিয়ে যাবে এই ভাবে ছুটতে লাগলেন, জীবনের চেয়ে প্রিয় মানুষটার যদি কিছু হয় এই ভেবে।
বাড়িতে পৌঁছে গিয়ে দেখলেন, তাদের প্রিয় রাজকন্যা চেয়ারে পা দুলিয়ে দুলিয়ে পাঁপড় ভাজা খাচ্ছে।
কে বাড়িতে নিয়ে এসেছে জিজ্ঞাসা করতে, সে ঘরে বসে থাকা একজন লোকের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।
দাদু বললেন: আরে সুখেন না।
সুখেন বললে: হ্যাঁ বাবু।
সুখেন হলো বুবুদের গ্রামের একজন রিক্সাচালক। একটু বয়স্ক, কিন্তু পরিমল বাবুর থেকে বয়সে একটু ছোট। তাই পরিমল বাবু তাঁকে নাম ধরেই ডাকেন। মাঝে মধ্যে বুবু এই রিক্সাটি করেই নিকিলবাবু বা পরিমল বাবুর সাথে বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করে।
পরিমল বাবু স্বস্থির নিশ্বাস ছেড়ে, জামা কাপড়টি পরিবর্তন করে সমস্ত বিষয় টা জানতে চাইলে। সুখেন বাবু জবাবে বললেন যে,
“বাড়িতে ফিরতে গিয়ে দেখি বুবুকে, মনটা কালো করে জানালার উপর হাত রেখে কাঁদো কাঁদো ভাবে রয়েছে।বৃষ্টির জন্য বাড়ি থেকে কেও আসতে পারছে না বলে, আমি প্রধান শিক্ষিক কে বলে বাড়িতে নিয়ে এলাম”।
কথার প্রসঙ্গে সুখেন বাবু আরও বললেন যে,
“বয়সের কারণে ইদানিং খুব একটা আয় হচ্ছেনা, তাই পাশের গ্রামে ক্ষেতমুজুরের কাজ করতে গিয়েছিলাম। ছোট বেলায় ঠিক করে পড়াশুনো করিনি, যখন শক্তি সামর্থ ছিল ভালো কোনো কাজ শিখিনি। আয় যখন করেছি, তখন ভবিষ্যতের জন্য কোনো সঞ্চয় করিনি, তাই এখন আমার এই অবস্থা। জানেন বাবু আমার মেয়ের ঘরের একটা নাতনী আছে, পুরো বুবুর মতো। কতদিন দেখতে যেতে পারছি না, কয়েকটা টাকার অভাবে। বয়সের কারণে কেও আমার রিক্সায় ওঠেনা, আমার শারীরিক কষ্টের কথা ভেবে, কিন্তু আমি চলব কী করে। তাই পাশের গ্রামে, ক্ষেতের কাজ করতে গিয়েছিলাম যদি কিছু উপার্জন হয়, কিন্তু বর্ষার কারণে সব ভেস্তে গেল”।
সব শুনে পরিমল বাবু, সুখেন বাবুর হাতে দুশো টাকা দিতে গেলেন, কিন্তু সুখেন বাবু নিলেন না। যেতে যেতে বলে গেলেন, “ আপনি আমার রিক্সায় উঠলে টাকা নেব, নাতনী তো বুবু আমারও। তার টাকা টা আমি নেব কী করে”।
-written by ©thesudipbiswas
0 Comments
Please do not enter any spam link in the comment box