নদীর পার


কখনো কখনো জীবনে কিছু জড়তা লক্ষ্য করা যায়। সেই অবস্থা থেকে জৈবতা ফিরে পেতে জীবনে কিছু  সুষ্ঠ এবং পর্যাপ্ত জীবনধারার প্রয়োজন এসে পরে। 

ঘটনাটি তখনকার যখন বুবু তার জীবনের প্রথম মেলা দেখতে, তার বাবা নিখিলবাবুর সাথে বেড়িয়েছে। গ্রাম থেকে একটু দূরে বাৎসরিক শীতলামায়ের পূজা এবং সেই উপলক্ষে নদীর পার ঘেঁষে এক বিশাল মেলা। অনেক পুরানো এই মেলা, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর মলিনতাতে নাব্যতা এসেছে। যেই স্থানে পুজোটা শুরু হয়েছিল, আজ নদীর পার ধসতে ধসতে তার বিশলতার ক্রমঃনাশ ঘটেছে। 

বুবু মেলায় যাবে বলে,  মা তার আদরের মেয়ের রেশমের মতো সুন্দর চুলরাজি লাল-ফিতে দিয়ে সুন্দর করে বেণী বেঁধে দিয়েছেন। বুবু তার শিশুসুলভ ছন্দে বাবার হাত ধরে মেলার বিভিন্ন প্রান্তে একবার এদিকে, একবার ওদিকে ঘুরছে এবং তার পছন্দের জিনিস গুলো তার প্রিয় বাবাকে বোঝাচ্ছে। 

সন্ধ্যা বয়ে রাত হতে চলেছে, কিন্তু মেয়ের উচ্ছাসের বিন্দুমাত্র ম্লান ঘটেনি। হঠাৎ নিখিলবাবুর খেয়াল করলেন মেলাতে কিছু আদিবাসী এসেছেন এবং তারা মেলার উদ্যোক্তাদের সাথে ঝামেলায়  যুক্ত  হয়ে গেছে। বিষয়টা একটা বাড়তে দেখে নিখিলবাবু কৌতুহলবশত একটু এগিয়ে গিয়ে দেখেন যে, অশান্তিটা ক্রমশ বেড়ে চলছে, ঘটনাচক্রে জানা যায় যে, আদিবাসীরা যে গাছ-গাছালি রোপণ করেন এই মেলার জন্য  সেই গাছগুলি অল্পতেই কেটে ফেলা হয়। ফলস্বরুপ নদীর পার আলগা হয়ে যাচ্ছে এবং  এই আদিবাসী শ্রেণীর জমিজমা নদীগর্ভে সমাহিত হয়ে যাচ্ছে। 

ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বাবা বিন্দুমাত্র ঝামেলায় যেতে চাননা, কিন্তু ছোট্ট মেয়ের কৌতুহল বাবা নিখিলবাবুর থেকে একটা হলেও বেশি। 

কিছুটা এগিয়ে যেতে গিয়ে বুবু খেয়াল করলো যে, তার থেকেও বয়সে ছোট্ট একটি আদিবাসী শিশুর হাতে,  ভাঙা একটি মাটির পুতুল রয়েছে এবং সে বুবুর সদ্য কেনা খেলনা গুলোর দিকে একভাবে চেয়ে রয়েছে। বুবু তার বাবার সাথে একপা সামনে এগোলে, সে তার বাবার পিছনে দুইধাপ পিছিয়ে যায়। 

এই পৃথিবীতে সবাইকে বোঝাতে হয়, কিন্তু বাবা-মাকে বোঝাতে হয় না। নিখিলবাবু বিষয়টা যখন বুঝতে পারলেন এবং শিশুটির সাথে কথা বলতে চাইলেন। কিন্ত তিনি অনুভব করলেন যে শিশুটি ভয় পাচ্ছে। শিশুটির বাবার সাথে কথা বলে, নিখিলবাবু  জানতে পারলেন যে বছর দুই আগে এই নদীর পারেই এদের মতো অনেকের মাটির ঘর ছিল এবং এই নদীর পার ভাঙার জন্য এই শিশুটি তার বড় ভাই এবং মাকে হারায়। আর এই পার ভাঙ্গার কারণে কোনো না কোন পরিবারকে তাদের কাছের মানুষ, গবাদী পশু এবং তাদের সাধ্যর স্বল্প কিছু সম্পত্তি হারিয়ে হৃতসর্বশ হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

আর তারা কখনো চাইবে না, আর কোনো মানুষ তাদের পরিবার, ধনসম্পত্তি হারায়। এই আদিবাসীরা এখানে লড়াই করতে বা মেলা বন্ধ করতে আসে নি, তারা এসেছে এই উদোক্তাদের কাছে প্রার্থনা করতে, তারা যেন মেলার নাম করে গাছ-গাছালি গুলো কেটে না ফেলে এবং পরিবেশকে কিভাবে সুন্দর রাখা যায় তার ব্যবস্থা যাতে সুন্দর ভাবে করে।

নিখিলবাবু বিষয়টা বুঝতে পারলেন এবং তিনি তার আদরের মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন যে, “তুমি কী কিছু বুঝতে পারলে, ছোট্ট বুবু বললে, “ আমি আমার একটা খেলনা, এই বোনুটাকে দিতে চাই”।

-written by ©thesudipbiswas



Post a Comment

0 Comments